জেফরি ডামার- এক নরপিশাচ ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারের গল্প!
জেফরি ডামার- এক নরপিশাচ ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারের গল্প!
সেনাবাহিনীর
মেডিক্যাল কোরে কাজ করেছেন দুই বছর, মানুষের জীবন বাঁচানোটাই ছিল
লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য। কিন্ত একই মানুষটার ভেতরে যে একটা খুনী স্বত্ত্বা লুকিয়ে আছে, মনের ভেতরে জমে আছে অযৌক্তিক প্রতিহিংসা
আর সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার অদম্য বাসনা- সেটা ক’জনে জানতেন? পরিবারের মানুষগুলোও তো চিনতেন
না তার এই রূপটাকে! মানুষটার দেহের ভেতরে বসত করতো সাক্ষাত এক হিংস্র পিশাচ, কীর্তিকলাপ আর খুনে মানসিকতায়
যিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার হিসেবে! নাম
তার জেফরি ডামার, আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত খুনী, সতেরোজন মানুষকে একাই মেরে
ফেলেছিলেন যিনি!
শৈশবটা
মোটেও মধুর ছিল না তার। বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়াটাই দেখে এসেছেন সবসময়। দুজনের কেউই
তাকে সময় দিতে পারতেন না ঠিকমতোন। যে বয়সটা আদর ভালোবাসায় হেসেখেলে কাটানোর কথা, সেই সময়ে স্নেহ বা মায়া
শব্দগুলোর সঙ্গে তার পরিচয়ও ঘটেনি। মানসিকতায় পরিবর্তন আসার পেছনে এসব ব্যপার
নিশ্চয়ই ভূমিকা রেখেছে। আবার অনেকে মনে করেন, চার বছর বয়সে ডাবল হার্নিয়ার
অপারেশনের জন্যে যে সার্জারীটা করা হয়েছিল তার শরীরে, সেটাই তার খুনে মানসিকতার কারণ।
একদম
ছোটবেলা থেকেই ঝগড়াতে মনোভাবের ছিলেন। ডামার, স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে অকারনেই
ঝামেলা বাঁধিয়ে দিতেন। স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের কাছে তার নামে অভিযোগের ফিরিস্তি
যেত রোজ। স্কুল ছাড়ার আগেই মাদক ধরলেন, একবার তো শিক্ষকের কাছে ধরাও
খেয়েছিলেন বোতলসহ। আঠারো বছর বয়সে কোনমতে গ্র্যাজুয়েশন করে বের হলেন স্কুল থেকে, একই বছরে তার বাবা-মায়ের
ডিভোর্সও হয়ে গেল। ডামার থেকে গেলেন বাবার সঙ্গে।
সেবছরই
প্রথম খুন করলেন ডামার। এক ছেলে বন্ধুকে নিয়ে বাসায় মদ খেলেন, নেশা চড়ে যাবার পরে বন্ধুটি
নিজের বাড়িতে ফিরতে চাইছিলেন। ডামার তখন ডাম্বেল দিয়ে মাথায় আঘাত করে তারপর খুন
করলেন তাকে। এই খুন সম্পর্কে পরে ডামার বলেছিলেন, নেশার ঘোরে মনে হচ্ছিল ও আমাকে
ছেড়ে চলে যাবে, তাই ওকে মেরে ফেলেছিলাম আমি! খুন করেই ক্ষান্ত হননি ডামার, মৃতদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে
ফেলেছিলেন, সেগুলো পলিথিনের ব্যাগে ভরে মাটিচাপা দিয়েছিলেন ঘরের পেছনে।
ডামারের
মাদকাসক্তির পরিমাণ বাড়ছিল ভয়াবহ হারে। এরমধ্যে বাবা তাকে ভর্তি করিয়েছিলেন ওহিও
স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, কিন্ত মাদকাসক্তির কারণে এক সেমিস্টার পরেই বেরিয়ে আসতে হলো সেখান
থেকে। আর্মিতে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেলেন বাবা, আইকিউ খুব ভালো ছিল ডামারের, টিকে গেল পরীক্ষায়। কিন্ত ১৯৮১
সালে সেখান থেকেও মাদক গ্রহণের দায়ে বের করে দেয়া হলো। বাবা তদ্দিনে বিয়ে করেছেন
আবার, ঘরে সৎ মা। ডামার আর বাবার কাছে ফিরলেন না, চলে গেলেন দাদীর বাড়ীতে।
মাঝেমধ্যেই পাগলাটে আচরণ করতেন তিনি, একবার তো পুলিশে ধরা খেয়েছিলেন
ছোট দুটো বাচ্চার সামনে হস্তমৈথুন করে। সেবার তাকে এক বছরের গৃহবন্দীত্বের সাজা
দেয় আদালত।
১৯৮৭ সালে
দ্বিতীয় খুন করে ডামার। এবার তার শিকার স্টিভেন টওমি নামের এক যুবক। একটা পার্টি
থেকে টওমিকে নিয়ে হোটেলে গিয়েছিলেন ডামার, দুজনে ভরপেট মদও খেয়েছিলেন। এরপর
মাথাল অবস্থায় টওমিকে খুন করেন ডামার। সকালে হুশ ফিরলে একটা বড় স্যুটকেস এনে সেটায়
লাশটা ভরে নিয়ে যান দাদীর বাড়ীতে, লুকিয়ে রাখেন বেজমেন্টে। কয়েকদিন
সেখানেই ছিল স্যুটকেসটা, ডামার কয়েকবার সেই লাশের গায়ে হস্তমৈথুন করেছিলেন বলে জানা যায়! দাদী
তার নাতির এসব লেট নাইট পার্টি সম্পর্কে জানতেন, শোধরানোর চেষ্টাও কম করেননি।
কিন্ত একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তবে ঘুর্নাক্ষরেও তিনি ভাবতে পারেননি যে ডামার এমন
কিছু করে বেড়াচ্ছে!
১৯৯১ সালে
জেল খেটে বের হলেন ডামার, এরপরেই সবাইকে ধ্বংস করে দেয়ার একটা বাসনা মনে চেপে বসলো যেন। সেবছর
মে মাসের সাতাশ তারিখে ডামারের প্রতিবেশী সান্ড্রা স্মিথের ফোন পায় পুলিশ; স্মিথ জানান, এক আফ্রো-আমেরিকান তরুনকে নগ্ন
অবস্থায় রাস্তায় ছুটতে দেখেছেন তিনি, ছেলেটার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিলেন
ডামার। পুলিশ আসে দ্রুত, কিশোর ছেলেটা আবোলতাবোল কথা বলছিল তখন, মোটামুটি উদভ্রান্ত সে তখন।
ডামার পরিস্থিতি নিজের দিকে নিয়ে যায় পুলিশকে মিথ্যে বলে, সে জানায় ছেলেটি তার প্রেমিক, দুজনের ঝগড়া হয়েছে। আমেরিকায়
সমকামীদের সংখ্যা অনেক, আর তাই পুলিশও ব্যপারটাতে গোলমালের কিছু খুঁজে পায়নি সেই মূহুর্তে।
পুলিশ যাবার পরে ডামার ছেলেটিকে নিজের ঘরে নিয়ে খুন করে। ছেলেটার বড় ভাইও ডামারের
হাতে খুন হয়েছিল এর আগে, তার লাশটাও খুঁজে পায়নি পুলিশ!
সেবছর মে
থেকে জুলাই মাসের প্রতিটা সপ্তাহেই ডামার অন্তত একজন মানুষকে খুন করেছিল। প্রায়
সবাই ছিল বয়সে তরুণ, আর তার প্রতিহিংসার শিকার হওয়া মানুষগুলোর বেশীরভাগই আফ্রো-আমেরিকান।
জুলাইয়ের বাইশ তারিখে ট্রেসি এডওয়ার্ড নামের একজনকে খুনের উদ্দেশ্যে বাসায় নিয়ে
আসে ডামার, তাকে হ্যান্ডকাফ পরাতে গিয়ে ধ্বস্তাধস্তি হয়, কিন্ত শরীরে ছুরির আঘাত নিয়েও
পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ট্রেসি। সে যখন থানায় পৌঁছায়, তখনও তার হাতে হ্যান্ডকাফ
ঝুলছিল! পুলিশ এবার কাজে নামে। ট্রেসির দেয়া তথ্যমতে গ্রেফতার করা হয় ডামারকে।
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সতেরো খুনের রক্তে রঞ্জিত এক আজদাহা অজগর, যার নাম জেফরি ডামার!
পুলিশ তদন্ত করে এতদিনের অমিমাংসিত খুনগুলোর রহস্য উদঘাটন করে এবার, ডামারও জেরায় স্বীকার করে সব
কিছু। তবে দাবী করে নেশার ঘোরে এসব করেছে সে, তার মানসিকতা পরিবর্তনের জন্যে
আসলে সেই সার্জারী অপারেশনতা দায়ী ইত্যাদি। আদালতের কাছে অবশ্য আমল পায়নি সেটা।
১৯৯২ এর পনেরোই ফেব্রুয়ারী, দশ ঘন্টার লম্বা শুনানি শেষে বিচারক তাকে প্রমাণ হওয়া পনেরোটি খুনের
অপরাধে সাড়ে নয়শো বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মানুষকে খুন করে তাদের মাথার খুলি আর
হাড় জমানোর শখ ছিল ড্রামারের, তাকে গ্রেফতারের পর দাদীর বাড়ীর
বেজমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয় চার বস্তা মানুষের হাড়
জীবনটা খুব অদ্ভুত, জীবনের নিয়ম নীতিগুলো আরো
অদ্ভুত। প্রকৃতি অযাচার অনাচার সহ্য করে না, অপরাধীকে শাস্তি দেয় নিজের হাতে।
সতেরোজন নিরপরাধ মানুষকে খুন করে পৃথিবীর আলো বাতাসে হেসেখেলে বেড়াবে জেফরি ডামার, এটা প্রকৃতির বিধানে নেই। জীবনটা
যার সিনেমার মতো নাটকীয়, তার শেষটাইয় দারুণ কোন রোমাঞ্চ না থাকলে কেমন দেখায়? সেকারনেই বোধহয়, গল্পের শেষে তুলির আঁচড়টাও ছিল
অদ্ভুত রকমের। ১৯৯৪ সালের আটাশে নভেম্বর কারাগারের ব্যায়ামাগারে কাজ করার সময় কথা
কাটাকাটির জের ধরে ক্রিস্টোফার স্কেভার নামের আরেক কয়েদির হাতে খুন হন ডামার।
প্রকৃতির বিচার দেখুন, স্কেভার আবার ছিলেন আফ্রো-আমেরিকান, ডামারের মস্তিষ্কবিকৃত অপরাধের
বেশীরভাগ শিকারও তো ছিলেন আফ্রো-আমেরিকান। ব্যাপারটা কি শুধুই কাকতালীয়? না বোধহয়!
জেফরি ডামার নেই, আছে তার কূকীর্তিগুলো। মিলওয়াকী
শহরের মানুষজন স্বীকার করতেও লজ্জা পায় যে ডাম্বার সেই শহরের সন্তান ছিল। শহরের
ব্যবসায়ীরা একত্রে টাকা তুলে নিলামে ওঠা ডামারের জিনিসপত্র কিনে ধ্বংস করে
ফেলেছিলেন, যাতে এই পিশাচটার কোন স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে।
তথ্যসূত্র-
1. উইকিপিডিয়া,
2. https://www.biography.com/people/jeffrey-dahmer-9264755
http://www.therichest.com/shocking/17-insane-facts-you-didnt-know-about-jeffrey-dahmer
No comments